সমাজে এক ধরনের কথা প্রচলিত আছে, ডাক্তার আর উকিলের কাছে কিছু লুকিও না, তাতে ভালোর চেয়ে মন্দ হবার সম্ভাবনা বেশি।
অনেক ডাক্তারের বিরুদ্ধে রোগীদের কথা না শোনার যেমন অভিযোগ আছে তেমনি অনেক রোগী আছেন যারা ডাক্তারের কাছে গিয়ে কী বলতে গিয়ে কী বলেন, খেই হারিয়ে ফেলেন। ফলে ডাক্তার বিরক্ত হন, কখনওবা উত্তেজিত।
একজন চিকিৎসক কখনোই চান না তাঁর কারণে কোন রোগী দুর্ভোগ পোহাক বা তাঁর কোন দুর্নাম হোক। তারপরও আমরা প্রতিদিন চিকিৎসকদের নামে এহেন নানান অভিযোগ অনুযোগ শুনতে পাই।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রাখতে এবং এর সুনাম ধরে রাখতে প্রতিটি অভিযোগ অনুযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। দোষী হলে বিচার করা উচিত।
রোগীরা প্রায়শই অভিযোগ করেন, ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন আমার রোগ কখনই ভালো হবে না। কেন হবে না জিজ্ঞেস করায় তিনি দুর্বব্যবহার করে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
ওই রোগীরা জানিয়েছে, তারা বিদেশে গিয়ে জেনেছেন এসব কিছুই হয়নি। সব রিপোর্ট ভুয়া। তারা সব টেস্ট আবার করেছে। খুব ভালো ব্যবহার আর আদর যত্ন করেছে। তবে বলেছে, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আরো আগে আসলে নাকি ভালো হতো। এরকম ডিপ্লোম্যাটিক টাইপ কথাবার্তা।
আসলে এসব কথাবার্তা অনেক প্যাঁচালো। মুখে মুখে ধ্বনিত হওয়ায় তা অনেক পরিবর্তিত। ক্ষেত্র বিশেষে এগুলো অনেকটা প্রতিহিংসামূলক কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর এসব উক্তি বেশিরভাগ দালালরাই করে, অনেক টা মূল উক্তিকে টুইস্ট করে।
মনে রাখবেন, আমাদের দেশে বিদেশী হাসপাতালের বা ডাক্তারদের অনেক দালাল বা এজেন্ট আছে। বিভিন্ন সূত্রের খবরে জানা যায়, এসব দালাল রোগীকে ভাগিয়ে নিয়ে বিদেশি হাসপাতালে ভর্তি করতে পারলে তার লভ্যাংশ থেকে একটা কমিশন পায় বিদেশী হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের কাছ থেকে।
চিকিৎসা-প্রযুক্তি গত দিক দিয়ে আমাদের দেশ কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো পিছিয়ে থাকতে পারে তবে চিকিৎসকদের জ্ঞান, যশ, অভিজ্ঞতা বিবেচনা করলে আমাদের দেশের চিকিৎসকরা পাশ্চাত্যের অনেক দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমপর্যায়ের পড়েন, এটা পাশ্চাত্যের চিকিৎসকরা অনায়াসে স্বীকার করেন।
তাই আমি বলবো অযথা আবেগের বশবর্তী না হয়ে কিংবা কোনো দালালের খপ্পরে বা ফাঁদে পা না দিয়ে বরং বাস্তবতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিন। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র আপনার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যার তত্ত্বাবধানে আছেন তার “স্বতঃস্ফূর্ত” পরামর্শ মেনেই আপনি আপনার রোগীকে নিয়ে রেফার্ড চিকিৎসক বা বিদেশের হাসপাতালে যাবেন। চিকিৎসার ব্যাপারে সর্বদা একজন চিকিৎসক এর পরামর্শ নিয়েই চলা উচিৎ। নন ডাক্তার বন্ধু বান্ধবী আত্মীয়স্বজন বা আর কারো পরামর্শ মতো চললে তা আপনার বা আপনার রোগীর জন্য কেবল দুর্ভোগই নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু আপনার অভিযোগ, আপনার ডাক্তার আপনার কথা শুনেন না।
দুই.
আসুন এবার একটু ব্যতিক্রমী প্রসঙ্গে আসি। চিকিৎসক দেবতা নন। তিনিও আপনার মতই একজন মানুষ। রাগ ক্ষোভ মান অভিমান তারও থাকতে পারে। আপনার সুচিকিৎসার স্বার্থে তাই আপনার চিকিৎসককে সহযোগিতা করা উচিৎ । আপনি যেমন তীর্যক কথাবার্তায় ক্ষুব্ধ হন একজন চিকিৎসকও তেমনি তার ব্যপারে তীর্যক মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হবেন এটাই স্বাভাবিক।
চিকিৎসককে বিব্রতকর কিছু বলা হলে বা করা হলে তা সুচিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটে। তাই চিকিৎসক বা চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা এখন আপনাকেই করতে হবে।
আমরা অনেকে নিজের অজান্তে চিকিৎসককে সেবা নেবার সময় নানা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন বা তীর্যক মন্তব্য করে তাকে বিব্রত করে তুলি। যা কখনই উচিৎ নয়।
তাই আসুন এবার জেনে নেই একজন চিকিৎসক যেসব কথায় বিব্রত হন-
চেম্বারে গিয়ে যদি চিকিৎসককে গিয়ে কেউ বলে- “আপনি কি এই রোগের চিকিৎসা জানেন?”
কিংবা
“দেখুনতো, আপনি কি অতি উচ্চ মাত্রায় ঔষধ দিয়ে দিলেন কিনা?” বা
“আপনি বাজে কোম্পানির ঔষধ প্রেসক্রাইব করলেন কিনা?”
এরকম প্রশ্ন অনেক সময় চিকিৎসককে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দেয়। আর এসব প্রশ্নের জন্যে তাঁরা অনেক সময় রিয়্যেক্টও করে বসেন। তাই নিজের বা আত্মীয়স্বজনের সুচিকিৎসায় আপনি কখনোই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলো করতে যাবেন না-
♦ আপনি কি এ রোগ সম্পর্কে জানেন? আপনি আমাকে সঠিক ঔষধ দিচ্ছেন? আপনি কি চিকিৎসা করতে পারেন?
♦ আপনি কী রোগের বিশেষজ্ঞ? বা আপনার ঔষধ কি আদৌ কাজ করবে?
♦ যা দিলেন তার চেয়ে ভালো ঔষধ নাই? বা আপনার চিকিৎসা না নিয়ে বরং বিদেশে যাই?
♦ ঔষধ কি খাবো, না আর কারো কাছে যাবো? এই ঔষধের কি বড় ধরনের সাইড এফেক্ট হয় বা এই ঔষধ খেলে মানুষ মরে যায়?
♦ প্রেশক্রিপশনের সকল ঔষধ কিনবো? আপনার ঔষধ না খেয়ে কি অপেক্ষা করি? বা এটা না খেলে কি হবে ওটা না খেলে কি হবে?
♦ পরীক্ষা গুলো না করলে হবে? পরীক্ষা কমিয়ে দেয়া যায় না? আমাকে কোনও পরীক্ষা দিবেন না বা আমাকে রক্তের সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেন দিচ্ছেন না?
♦ আপনি কি বড় ডাক্তার? আপনার চেয়ে ভালো ডাক্তার কি আছেন? আপনার বিদেশী ডিগ্রী আছে?
বা আপনি কি প্রফেসর?
♦ আপনার চেম্বারে এতো ভিড় কেন? বা আপনার চেম্বারে রোগী নাই কেনো?
♦ আপনি কি পাওয়ারফুল ঔষধ দেন? আমাকে কম পাওয়ারের ঔষধ দিবেন, ওকে?
♦ আমি দেশের চিকিৎসকদের দিয়ে চিকিৎসা করাই না, না পেরে আসলাম, আপনারটা নিবো? ক্ষতি হবে আমার?
♦ ডাক্তার আপনি কি বিবাহিত? ডাক্তার আপনার বাড়ি কই? আপনার বিদেশি ডিগ্রী কয়টা?
হাস্যকর বা অযৌক্তিক হলেও এ সব প্রশ্ন কমবেশি অনেক চিকিৎসককেই শোনতে হয়। হয়ত না বুঝেই সহজ সরলভাবেই অনেকে এসব অহেতুক কথা বলেন। আমি বলছি না এসকল প্রশ্ন করা যাবে না। কিন্তু এসব কথার কারণে একজন চিকিৎসক বিব্রত হতে পারেন।
তিন.
আপনার অনেক জিজ্ঞাসা থাকতে পারে। এটা আপনার অধিকার। তবে একটা ব্যাপার মনে রাখবেন, উপস্থাপনা বা বাচন ভংগীতে ভালো জিনিস ও অনেক সময় খারাপ হয়ে যায়। গ্লাসে যদি অর্ধেক পানি থাকে তবে তা তিনভাবে প্রকাশ করা যায়,
১) গ্লাস অর্ধেক খালি।
২) গ্লাসে অর্ধেক পানি আছে।
৩) গ্লাসে অর্ধেক জল বাকিঅর্ধেক অক্সিজেন।
বিষয়টি আরও সহজ করে বলি, ধরুন আপনি একজন আইনজীবী, মক্কেল প্রশ্ন করলো, “আপনি কি আইন সম্পর্কে ভালো জানেন? বা একজন উচ্চমানের সংগীত শিল্পী শ্রোতা বললো, “ম্যাডাম, আপনি কি সারেগামা জানেন?” একজন স্বনামধন্য আর্কিটেক্টকে বাড়ি বানাতে গিয়ে বললেন, “ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, আপনি জানেন এক স্কয়ার ফুট ঢালাইতে কত কেজি রড লাগে?” বা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, “রড কমিয়ে তার পরিবর্তিতে দুইটা বাঁশ দিলে হয়না?” এসব প্রশ্ন হাস্যকর, সম্মানহানিকরো বটে ।
আপনার স্থাপনায় রডের পরিবর্তে বাঁশ দিতে চাইলে আপনি আর্কিটেক্টকে কৌশলে বলতে পারেন, “ভাই, রডের পরিবর্তে কেউ বাঁশ দিলে কি হবে?”
আচ্ছা বলুন কেউ যদি ফার্স্ট ডেটে গিয়ে তার প্রেমিকাকে বলে, “তোমার বয়স কত” তাহলে কি “সেটা আত্মঘাতী গোল” কিংবা “ডি বক্সে ফাউল” হয় না?
আপনার জ্ঞাতার্থেই বলছি, চিকিৎসা বিষয়ক উপরোক্ত প্রশ্নগুলো সরাসরি এভাবে না করে বুদ্ধিদীপ্তভাবে করুন বা ডিপ্লোম্যাটিক হোন। আপনার অধিকার আছে আপনার চিকিৎসকের কাছ থেকে রোগ সম্পর্কে সব কিছু জানার। তবে সেটা মানহানিকর প্রশ্নের মাধ্যমে নয়। যেমন আপনি অন্য চিকিৎসক দেখাতে চাইলে বলতে পারেন, “ডাক্তার সাহেব, আপনি যা পরামর্শ দিবেন আমি তাই শুনবো, যেখানে যেতে বলবেন সেখানেই যাবো’। ব্যাস, এটুকু। বিজ্ঞ চিকিৎসক বুঝে নেবেন আপনি কী বলতে চাইছেন।
হ্যাঁ আপনি বলতে পারেন, রোগে শোকে থাকলে বা পড়লে রোগী বা স্বজনরা অনেক সময় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। মুখ ফসকে, আবেগে কী বলতে কী বলে ফেলেন।
আর চিকিৎসক মহোদয়দের প্রতিও আমার আকুল আবেদন থাকবে, রোগী বা স্বজনদের এ ধরনের “গুগলি” প্রশ্নে আপনাদের যেন কস্মিনকালেও ধৈর্যচ্যুতি না হয়।
লেখাটা শেষ করি এক ব্রাহ্মণ পরিবারের করুণ কাহিনী দিয়ে। আমি তখন নবীন চিকিৎসক। কলে (অনুরোধে) গিয়েছি একেবারে রিমোট এলাকায় তিন চার কিলো কাদাজল মাড়িয়ে। গিয়ে দেখি নেহায়েত দারিদ্র ব্রাহ্মণের ঘরে বসার কিছুই নেই। দারিদ্র ব্রাহ্মণ গায়ের গামছা খুলে একটা পিড়ি এনে সযত্নে মুছে দিয়ে বললেন, “আপনি ভগবান। মার্জনা করবেন। আপনাকে বসতে দেওয়ার জন্যে ঘরে একটা চেয়ার নেই।”
তাঁর সম্মান প্রদর্শনে মুগ্ধ হয়ে বিনা ফিতে খুব ঝুঁকি নিয়ে তার বাবার চিকিৎসা করি। সে যাত্রায় পরম দয়ালু আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন।
পুনশ্চ: চিকিৎসকের প্রতি শ্রদ্ধা বিশ্বাস আস্থা না থাকলে আপনার রোগ সারাটা মুশকিল হয়ে যেতে পারে।
লেখক: ডা. মো. সাঈদ এনাম, সাইকিয়াট্রিস্ট